ঢাকা সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

 মোমিনের দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়

 মোমিনের দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়

দোয়া মোমিনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। দোয়ার মাধ্যমে বান্দার অনেক সমস্যার সমাধান হয়। দুনিয়া ও আখেরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ হয়। হাদিসে আছে, দোয়া হলো ইবাদতের মগজ। (তিরমিজি :৩৩৭১)। দোয়া দ্বারা কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভাগ্যও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন রাসুল (সা.) বলেছেন: ‘কেবল দোয়াই তাকদির পরিবর্তন করতে পারে এবং নেক আমলই হায়াত বৃদ্ধি করে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম : ১৮১৪)। দোয়ার কিছু নির্ধারিত সময় ও পদ্ধতি আছে, যখন দোয়া করলে আল্লাহ পাক দ্রুত কবুল করেন। তবে সদা মনে রাখতে হবে, আমাদের সব দোয়া তৎক্ষণাৎ কবুল করা হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ‘তোমাদের কেউ যেন দোয়ায় তাড়াহুড়ো না করে এবং এ কথা যেন না বলে, আমি দোয়া করলাম, কিন্তু কবুল হলো না।” (বোখারি : ৬৩৪০, মুসলিম : ২৭৩৫)। তাই সর্বদা দোয়া করে যাওয়া উচিত। কিছু দোয়ার প্রতিফল আল্লাহ পাক আমাদের আখেরাতের জন্য রেখে দেন আবার কিছু দোয়ার বদৌলতে আমরা অনেক কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পাই।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার দোয়া কখনোই প্রত্যাখ্যান করেন না। তিনি বলেন: ‘আর যখন আমার বান্দারা তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন বলে দাও, আমি তো খুব কাছেই আছি। আহ্বানকারী যখন আমাকে ডাকে, তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। অতএব, তারা যেন আমার আহ্বানে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৬)। তবে, কিছু বিশেষ সময়ে মোমিন বান্দার দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। সাধারণত এ সময়গুলোতে দোয়া করা হলে তা কবুল করা হয়। দোয়া করার এমন কিছু বিশেষ মুহূর্ত উল্লেখ করা হলো :

জুমার দিন : হাদিস অনুসারে, জুমার দিনের এমন একটি সময় রয়েছে, যখন বান্দা যা চায় তাই কবুল হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:‘জুমার দিনে এক বিশেষ মুহূর্ত আছে, কোনো মুসলমান সে সময় দোয়া করলে তা অবশ্যই কবুল হয়।’ (বোখারি : ৯৩৫, মুসলিম: ৮৫২)। এ সময়টি কখন তা শরীয়তপ্রণেতা মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা) থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তবে বিশিষ্ট আলেমগণ বলেছেন, জুমার আজানের সময় হতে জুমার নামাজের শেষ পর্যন্ত সময়। অনেকের মতে, জুমার দিন সূর্যাস্তের আগে দোয়া কবুলের অন্যতম সময়। কেউ কেউ বলেছেন, জুমার নামাজের দুই খুতবার মধ্যবর্তী সময়। বিশেষত জুমার দিন আসরের নামাজের পর নামাজের মুসাল্লায় বসে ৮০ বার দরুদ পড়ার আমল খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

সাহরি ও ইফতারের সময় : সাহরির সময় যে দোয়া করা হয় তা আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। কেননা, শেষ রাতের ইবাদত আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘আমাদের প্রতিপালক প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আমার কাছে দোয়া করবে, আমি কবুল করব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব?’ (বোখারি : ১১৪৫, মুসলিম: ৭৫৮)।

এমনিভাবে ইফতারি সামনে রেখে আজানের পূর্বে যে দোয়া করা হয়, তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না: ন্যায়পরায়ণ শাসকের, রোজাদারের ইফতারের সময় এবং মজলুমের (অত্যাচারিতের) দোয়া।’ (তিরমিজি : ২৫২৫)।

আজানের সময় : ‘আজানের পরে করা দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না’। (আবু দাউদ: ৫২১, তিরমিজি : ২১২)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন: আজানের সময় দুরুদ পড়ে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয়, তা কবুল করা হয়।’ (মুসলিম: ৩৮৫)।

ফরজ নামাজ শেষে : আবু উমামাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোন দোয়া সবচেয়ে বেশি শোনার যোগ্য (অর্থাৎ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি)?’ তিনি বললেন, ‘রাতের শেষ তৃতীয়াংশে এবং ফরজ নামাজগুলোর পরে।’ (তিরমিজি : ৩৪৯৯)।

এছাড়া সালাতুত তওবা, সালাতুল হাজত, সালাতুত তাসবিহসহ অন্যান্য বিশেষ নফল নামাজের পরে দোয়া করলে আল্লাহ পাক বান্দার মনোবাসনা পূর্ণ করেন।

গায়েব ব্যক্তির জন্য দোয়া : মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার ভাইয়ের জন্য অনুপস্থিত থাকা অবস্থায় যে দোয়া করা হয়, তা আল্লাহ দ্রুত কবুল করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যখন কোনো মুসলিম তার ভাইয়ের জন্য গোপনে দোয়া করে, তখন একজন ফেরেশতা বলেন, আমিন! এবং তোমার জন্যও তা হোক।’ (মুসলিম : ২৭৩৩)। এছাড়া আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন: ‘সবচেয়ে দ্রুত কবুল হওয়া দোয়া হলো একজন মুসলিমের তার ভাইয়ের জন্য গোপনে করা দোয়া।’ (তিরমিজি : ১৯৮০)।

ঈদের রাতে : দুই ঈদের রাত আমাদের জন্য অনেক ফজিলতপূর্ণ। তাই, আমরা এই রাতে দোয়া করতে পারি এবং অন্যান্য ইবাদত বেশি বেশি করার চেষ্টা করতে পারি। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন: পাঁচটি রাত এমন আছে, যখন দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না (এর মধ্যে অন্যতম) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত।’ (বাইহাকি : ৬১৯৫)।

এতেকাফের সময় : এতেকাফের দিনগুলোতে বান্দা নিজের সম্পূর্ণ সময় জুড়েই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে থাকে। এ সময়টি দোয়া কবুলের অন্যতম উপযোগী সময়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এতেকাফ করে, সে গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্য অন্যান্য নেক আমলের সওয়াব লেখা হতে থাকে, যেন কেউ সব নেক কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে।’ (ইবনে মাজাহ : ১৭৮১)। যেহেতু এতেকাফের সময় লাইলাতুল কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাই এ সময় দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম উপযুক্ত সময়।

লাইলাতুল কদর : বরকতময় রাতগুলোতে আমাদের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না। তাই রমজানের শেষ দশ দিনে আমাদের লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা উচিত। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশদিনে এতেকাফ করতেন এবং বলতেন, ‘তোমরা এই দশ দিনে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।’ (বোখারি : ২০২০, মুসলিম : ১১৭১)।

দোয়া কবুলের শর্তাবলি

দরুদ শরিফ পাঠ করা : দোয়া কবুলের জন্য খুব জরুরি হলো, দোয়া করার আগে দরুদ শরিফ পাঠ করা। বান্দা যখন দোয়া করে তা আসমানে উঠে আটকে থাকে অতঃপর যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপর দরুদ শরিফ পাঠ করা হয় তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘নিশ্চয়ই দোয়া আসমান ও পৃথিবীর মাঝখানে আটকে থাকে, যতক্ষণ না নবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করা হয়।’ (তিরমিজি : ৪৮৬)।

হালাল রিজিক গ্রহণ করা: হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে, সে ধুলো-মলিন ও ক্লান্ত, সে দুই হাত তুলে বলে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারাম দ্বারা লালিত হয়েছে, তাহলে কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১০১৫)।

অন্যের ক্ষতির দোয়া না হওয়া : বান্দা যদি তার অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্য ক্ষতিকর দোয়া করে, তা যদি তার জন্য উপযুক্ত না হয়, তাহলে দোয়াটি দোয়াকারী ব্যক্তির উপর বর্তায়। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বদদোয়া করে, অথচ সে অন্যায় কিছু করছে না, তবে সেই দোয়া বদদোয়াকারীর দিকেই ফিরে যায়।’ (আবু দাউদ: ১৫৩৩)। এছাড়া দোয়া করার সময় গোনাহের কাজে লিপ্ত না থাকা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:‘যখন কোনো বান্দা কোনো গোনাহ করে, আর সে যদি তার কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চায়, তবে তার দোয়া কবুল হয় না।’ (আহমদ: ৮৭৯৩)।

দোয়ার আদব : আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। তাই পবিত্র অবস্থায় দোয়াকারী ব্যক্তির দোয়া বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমাদের উচিত যথাসাধ্য পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর নিকট দোয়া করা। দোয়া করার সময় সর্বপ্রথম আল্লাহর প্রশংসা করে দরুদ পাঠ করা, তার নিকট নিজের গোনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করা, অতঃপর ব্যাপকভাবে আল্লাহর সকল মাখলুকাতের জন্য দোয়া করা এবং পরিশেষে নিজের মনোবাসনা কামনা করা।

এটাই দোয়া করার উত্তম পন্থা। হাদিসে উল্লেখ আছে,‘যখন তোমাদের কেউ দোয়া করবে, সে যেন প্রথমে তার প্রতিপালক আল্লাহর প্রশংসা করে, তারপর নবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করে, এরপর যা চায় তা প্রার্থনা করে।’ (তিরমিজি : ৩৪৭৭, আবু দাউদ: ১৪৮১)।

উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও দোয়া কবুলের জন্য আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো আমরা দোয়া করার সময় অনুসরণ করতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে বেশি বেশি দোয়া করার তৌফিক দান করুন ও আমাদের সকল দোয়া কবুল করুন। আমিন।

লেখিকা : শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মোমিন,দোয়া,কবুল,সময়
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত